সুদূর অতীত থেকেই কবিতা নিয়ে, কবিকে নিয়ে বহু বিতর্ক চলে আসছে। আমি বরাবর
এ বিষয়ে নীরব থাকি, কারন হিসাবে যদি মনে করেন, ‘আমি এই বিষয়ে কিছুই বুঝি
না!’ তাহলে আমার কিছু বলার আছে। আবার যদি মনে করেন, ‘আমার এই বিষয়ে পড়াশুনা
কম!’ তাহলেও আমার কিছু বলার আছে। আমি নীরব থাকি শুধু একটি মাত্র কারনে-
আমার দলাদলি/কোলাকুলি কোনটাই ভাল লাগে না!
বিন্দু bindumag.com
আমি কবিতা লিখি নিতান্তই আমার প্রয়োজনে! ব্যাপারটা খুলে বলি- কবিতা মানেই
আমার দেহে রক্ত চলাচল প্রক্রিয়ার মতই। আমি প্রকাশ্যে রঙ-ঢঙে বিজ্ঞাপন করি
না, খুব নিভৃতে, একাকী কবিতা চর্চা করি, আমাকে বাঁচাতে।
বিন্দু bindumag.com
কবিতার বহুমাত্রিকতা না থাকলে কবিতা হয়ে উঠে না, এটা সকলেই কম বেশি জানে।
কিন্তু কবিতার গভীরতা কীসে হয়? ভাষায় না কি ভাবে? এখানে পাঠকের দায়বদ্ধতা
আছে, নাকি কবির দায়বদ্ধতা? প্রশ্নগুলো তেমন জটিল বলে মনে হয় না!
আসুন, একটু ভাবি-
বিন্দু bindumag.com
কবিতার গভীরতা কীসে হয়, ভাষায়?
“আধুনিক কবিতা (!) জটিল কিছু শব্দে, বাক্যে জর্জরিত। এই অভিযোগ আমি অনেক
পাঠকের কাছে শুনে এসেছি। এমনিতেই কবিতার পাঠক কম, তার সাথে যদি শব্দ, বাক্য
কিছুই পাঠক না বোঝে তাহলে পাঠক সংখ্যা কমে যাবে!”
বিন্দু bindumag.com
আমি উপরের কথাগুলোর সাথে সহমত পোষণ করি না! প্রয়োজনের তাগিদে কবি তাঁর
ভাষার ঝুলি থেকে যে শব্দে, যে বাক্যে তাঁর প্রেয়সীকে সাজিয়েছেন, সেটা তাঁর
সাজানোর কৌশল অথবা তাঁর ভাল লাগা। আপনার মনে হয়েছে বাম দিকের তিলটা ঠোঁটের
নীচে আর একটু সরে গেলে ভাল হত। এটা তো আপনার মনে হয়েছে, আপনি সাজান আপনার
প্রেয়সীকে, আপনার মতো করে! আর আপনার মতো করেই যদি কবি সাজিয়ে যান তাহলে কি
আপনাকে কপি করা হয়েছে বলবেন না?
এবার আসি পাঠকের অভিযোগ বিষয়ে। কবি কি আসমান থেকে শব্দ নিয়ে এসেছেন? নাকি
নিজে আবিষ্কার করেছেন? বাক্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে শব্দ প্রয়োগ করেছেন
তিনি। শব্দগুলোর অর্থ খুঁজে নেবার দায়িত্ব আপনার। একজন কবি সারাটা জীবন
পাওয়া না পাওয়ার হিসাব না করে, নিজের আপন পর সকলকে ত্যাগ করে শুধু কবিতাকে
সাজিয়ে গেলেন আর আপনি গুটি কয়েক শব্দের অর্থ খুজে নেবার সময় পান না!
বিন্দু bindumag.com
কবিতায় ভাষার ভূমিকা কী? কবিতায় কি জানা-শোনা শব্দ বা বাক্য কোন
অজানা-অচেনা ভাষার উপস্থাপন করে? যার কারণে কবিতা কবিতাই হয়ে ওঠে? এর
প্রধান কারণ কবিতায় ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দ প্রথমেই তার চলমান অর্থের আবদ্ধতা
খুলে ফেলে। এই আবদ্ধতা খুলে ফেলার জন্য সে বিকৃত হয়ে যায় না। বরং চলমান
অর্থকে অতিক্রম করে বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে। এই কারণে শব্দ প্রয়োগে, বাক্য
গঠনে যিনি নিপুণতার পরিচয় দিতে পারবেন, তিনিই হয়ে উঠবেন যথার্থ কবি।
অন্যথায় কবিতা নিছক শব্দ-সমবায় ছাড়া কিছুই হয়ে উঠবে না।
উপরের কথাগুলো নিতান্তই আমার না, গুণীজনেরাও একই কথা কহেন।
বিন্দু bindumag.com
ভাব? ভাবনার সংক্ষিপ্ত রূপ। আপনি কী ভাবছেন, কীভাবে ভাবছেন, কোন প্রক্রিয়ার
ভিতর দিয়ে ভাবছেন এবং কেন ভাবছেন? এমন অনেক প্রশ্ন যদি আসে, সেইসব
প্রশ্নের উত্তর একত্রিত করে সারাংশটাই মনে হয় ভাব। কবিতা ভাব ছাড়া হয় বলে
আমার মনে হয় না।
বিন্দু bindumag.com
কবিতা প্রত্যেক কবির অভিজ্ঞতার লীলা। যে লীলা আপনাকে অনুভব করতে বাধ্য করবে
না, বরং অনুভব করার জন্য দরজা-জানালা খুলে আপনার নিজেকে দেখার আয়না তৈরি
করে দিবে। অনেকেই এভাবে মত পোষণ করেন- “কবিতা যতটা না বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজন
তার চাইতে অনেক বেশি আবেগের সঞ্চরণ”। শুধু কি আবেগিক প্রযোজনাই কবিতা? আমি
মনে করি, কবিতা হয়ে উঠার জন্য চাই দীর্ঘ চর্চার সাথে আবেগের শৈল্পিক
প্রয়োগ। কবিতায় যদি আবেগ সঞ্চালনের সাথে সাথে আবেগের শৈল্পিক প্রয়োগ না
থাকে তখন তা কবিতা হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ দীর্ঘ চর্চা, আবেগ ও অনুভবের সাথে
চিন্তার যথার্থ শৈল্পিক কারুকাজই কবিতা। মোটামুটি ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে
গেল ‘কবিতা ব্যক্তিনিষ্ঠ’। তবে কবির শিল্পিত শক্তি এবং ভাব প্রকাশের
কারুকাজ এইখানেই যে তা ব্যক্তিজীবন বা দর্শন প্রকাশ হলেও হয়ে ওঠে
সার্বজনীন।
বিন্দু bindumag.com
প্রকৃত কবিতার যাত্রা তাই একক থেকে বিশ্ব সংসারের দিকে। পাঠক যখন কোন কবিতা
পাঠ করে তখন সে নিজেও কবিতায় সাজানো অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যায়।
শিল্প-সাহিত্য মানুষের আবগেকে জাগিয়ে দেয়। কবিতা এই কাজটা সবচাইতে
নিখুঁতরূপে করতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। কবিতা পাঠের সময় পাঠকের সামনে তার
নিজের ভেতর লুকানো সুখ, দুঃখ, দর্শন, আবেগ সহ তার নিজের ভিতরে থাকা জগতটার
প্রকাশ ঘটে। এই আবিষ্কার আসলে নিজেকে নতুন ভাবে সৃষ্টি করা। এই সৃষ্টির
ফলে স্রষ্টার প্রতি (অর্থাৎ কবির প্রতি) আনুগত্য বাড়ে। বাড়ে নিজেকে
আবিষ্কারের সুখ।
বিন্দু bindumag.com
খুব সহজ কথায় বলি- শাদা ঘুড়ি আকাশে উড়তে উড়তে সুতা কেটে গিয়ে বাঁশঝাড়ের
মধ্যে সবচেয়ে উঁচু বাঁশটার মাথায় আটকে আছে, একটি শিশুকে চাঁদ দেখাবেন বলে, ঐ
ঘুড়িটা দেখিয়ে দিলেন! শিশুটি মেনে নেবে, এটাই স্বাভাবিক কিন্তু কোনও
কিশোরকে আপনি বোঝাতে পারবেন না , ঐটা চাঁদ! তেমনি কবিতার বেলায়ও আপনি যা
বলতে চাচ্ছেন, বোঝাতে চাচ্ছেন, সেই ম্যাসেজ বা ভাবটাকে যদি শব্দে বাক্যে
নিপুণভাবে সাজাতে না পারেন তাহলে ব্যর্থতা কবিজনের বৈকি। একটি কবিতা
সার্বজনীন হয়ে উঠেছে কিন্তু দু’-একজন পাঠক তাকে আয়ত্তে আনতে পারছেন না, এ
ব্যর্থতা পাঠকের, কবির নয়।
বিন্দু bindumag.com
ভাবের বিষয়টা আমরা দুই ভাবে নিতে পারি-
- এক- আপনি চাঁদ দেখাতে পারছেন না!
- দুই- আপনি চাঁদ দেখতে চাচ্ছেন না!
বিন্দু bindumag.com
প্রথমটাতে আমার আপত্তি নাই, দ্বিতীয়তে আছে। আপনি বিখ্যাত (!) কবির কবিতা
পাঠ করছেন, তিনি কবিতার কোন এক চরণে লিখেছেন ‘তমসাচ্ছন্ন’, ব্যাস, আপনি
পাগল হয়ে গেলেন, ‘তমসাচ্ছন্ন’ ‘ওরে বাবা, কী লিখছেন কবি!’ বাংলা অভিধান
খুঁজে খুঁজে তমসাচ্ছন্ন’র অতীত ইতিহাস থেকে বর্তমান ইতিহাস বের করে ফেললেন।
অপরদিকে অখ্যাত কবি লিখলেন- ‘রাজহাঁসবেশী’ এক কিশোরীর কথা; পাঠক, আপনার
চোখে পড়ল না নাকি মনে ধরল না!
বিন্দু bindumag.com
শুরু করেছিলাম কবিতার গভীরতা নিয়ে। জানিনা, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম
নাকি বোঝাতে সক্ষম হলাম। বিষয়টা আসলে এমন হল- কবিতায় ভাষা ও ভাবের শৈল্পিক
প্রয়োগ কবিতায় গভীরতা আনে। পাশাপাশি একথা স্বীকার করতেই হবে, পাঠকের
দায়বদ্ধতা থাকতে হবে অর্থাৎ পাঠককের অনুসন্ধিৎসু মনোভাব থাকতে হবে। তবে যদি
আপনি (কবিজন) মনে করেন- আমি বাপু আমার সমস্ত সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করেছি
আর পারছি না! তাহলে আমার মতো বলেন- ‘ভাই, আমি কবিতা যাপন করি! আমি কবি না!
তবে হতে চাই!’
0 মন্তব্য(গুলি):